যে ব্যক্তি তার ডান হাত নাড়াতে পারেন না ও ইবাদতের জন্য ব্যবহার করতে পারেন না তার নিম্নোক্ত শরয়ি বিধাগুলো মেনে চলতে সচেষ্ট থাকা আবশ্যকীয়:
এক: ডান হাত ভাঙ্গার কারণে ওযু ও গোসলের বিধান মওকুফ হবে না। কারণ তিনি বাম হাত ব্যবহার করতে পারেন, পানি নেয়ার ক্ষেত্রে বাম হাতের সহযোগিতা নিতে পারেন এবং পবিত্রতা অর্জনের জন্য ধোয়া ফরয এমন অঙ্গ-প্রতঙ্গে পানি পৌঁছাতে পারেন। তিনি ধীরস্থিরে পবিত্রতা অর্জনে সচেষ্ট থাকবেন; যাতে করে পরিপূর্ণভাবে পবিত্রতা অর্জন নিশ্চিত হতে পারেন।
দুই: ওযু বা গোসলের ক্ষেত্রে যখন প্লাস্টারকৃত ডান হাতের পালা আসবে তখন আপনি শুধু সে হাতের ওপর হালকাভাবে মাসেহ করলেই চলবে; এতে প্লাস্টারের কোন ক্ষতি হবে না। মাসেহ শুধু একবার করাই যথেষ্ট; ধৌত করার মত একাধিক বার নয়। এভাবে, ইনশাআল্লাহ্ সঠিকভাবে পবিত্রতা অর্জিত হবে। তবে এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরী যে, যদি ডান হাতের আঙ্গুলগুলো কিংবা কনুই প্লাস্টারের বাইরে থাকে তাহলে সেগুলো অবশ্যই ধৌত করতে হবে। প্লাস্টারের নীচে যে অংশ ঢাকা পড়ে আছে শুধু সে অংশ ছাড়া অন্য কিছু মাসেহ করা বৈধ হবে না।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
কখনও কখনও এমন হয় যে, প্লাস্টার হাতের তালুতে থাকে; আর আঙ্গুলগুলো খোলা থাকে। সেক্ষেত্রে আঙ্গুলগুলো ধৌত করা ও প্লাস্টারের ওপর মাসেহ করা আবশ্যকীয়। অনুরূপভাবে পায়ের ক্ষেত্রে পায়ের আঙ্গুলগুলো খোলা থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে আপনি আঙ্গুলগুলো ধৌত করুন এবং প্লাস্টারের ওপর মাসেহ করুন।[আল-লিকা আস-শাহরি, শামেলা (২৭/৬১)]
ইতিপূর্বে 69796 নং, 148062 নং ও 163853 নং প্রশ্নোত্তরে প্লাস্টারের হুকুম বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
তিন: নামাযে ডান হাতের কর্ম নিম্নোক্ত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ:
১. চারবার তাকবীর দেয়ার সময় হাত উত্তোলন করা (তাকবীরে তাহরীমা, রুকুতে যাওয়া, রুকু থেকে দাঁড়ানো ও মধ্যবর্তী বৈঠক থেকে উঠার সময়)।
২. দাঁড়ানো অবস্থায় বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা।
৩. সেজদাতে যাওয়ার সময় ভর করা।
৪. বসা অবস্থায় উরুর উপর রাখা।
৫. তাশাহ্হুদ পড়াকালে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা।
এ স্থানগুলোতে আপনি সক্ষম হলে প্লাস্টারকৃত ডান হাত নাড়াবেন এবং এ আমলগুলো আদায় করবেন; আর এটাই হচ্ছে উত্তম। যদি পরিপূর্ণভাবে নাড়াতে সক্ষম না হন তাহলে যতটুকু নাড়াতে পারেন ততটুকু করবেন। যদি আপনি একেবারে অক্ষম হন তাতেও কোন অসুবিধা নেই। এ আমলগুলো আপনি শুধু বাম হাত দিয়ে পালন করবেন; শুধু তাশাহ্হুদের ইশারাটা ব্যতীত। কারণ এ ইশারা কেবল ডান হাতেই করতে হয়।
পূর্বোক্ত আলোচনার সপক্ষে শরয়ি দলিল হচ্ছে—ফিকাহশাস্ত্রের দুটো সাধারণ নীতি; যে নীতিদ্বয়ের পক্ষে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর দশ দশ দলিলের সাক্ষ্য রয়েছে।
প্রথম নীতিটি হচ্ছে: المشقة تجلب التيسير (কাঠিন্য সহজায়ন আনে)। এর সপক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا (আল্লাহ্ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত)[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৮৬]
দ্বিতীয় নীতিটি হচ্ছে- الميسور لا يسقط بالمعسور (কষ্টসাধ্য সহজসাধ্যকে মওকুফ করে না)। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ (অনুবাদ: তোমরা সাধ্যমত আল্লাহ্কে ভয় কর)[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] এটি একটি মহান নীতি। এ নীতি সম্পর্কে আলেমগণ বলেন: "এটি এত ব্যাপক একটি নীতি; যতদিন শরিয়তের মৌলিক বিধানগুলো কায়েম থাকবে ততদিন এটি ভুলে যাওয়া যাবে না"[সূয়ূতী-এর 'আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের' (পৃষ্ঠা-২৯৩)]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
"নির্দেশিত আমলগুলো সাধ্য ও সক্ষমতার শর্তযুক্ত—এর উদাহরণ শরিয়তে ভরপুর। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) কে বলেন: তুমি দাঁড়িয়ে নামায আদায় কর, যদি তা না পার তাহলে বসে বসে আদায় কর, যদি সেটাও না পার তাহলে শুয়ে শুয়ে আদায় কর।"[সহিহ বুখারী (১১১৭)]
মুসলমানগণ এ মর্মে একমত যে, নামাযী যদি নামাযের কিছু ওয়াজিব পালনে অক্ষম হন; যেমন- দাঁড়ানো, ক্বিরাত পড়া, রুকু করা, সিজদা করা, সতর ঢাকা, কিবলামুখী হওয়া কিংবা অন্য কোন ওয়াজিব—তাহলে সে যা পালন করতে অক্ষম সেটা তার উপর থেকে মওকুফ হবে। তার উপর সেটা পালন করা ওয়াজিব যেটা পালন করার সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেটা পালন করার সাধ্য তার রয়েছে। বরং জেনে রাখা উচিত যে, শরয়ি নির্দেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে সামর্থ্য থাকার যে শর্ত রয়েছে সে ক্ষেত্রে শরিয়তপ্রণেতা ক্ষতিসমেত সামর্থ্য থাকাকে বুঝাননি। বরং বান্দার যদি আমল করার সক্ষমতা থাকে; কিন্তু এতে তার কিছু ক্ষতি সাধিত হয়; এমন সক্ষমতাকে শরিয়তের অনেক আমলের ক্ষেত্রে অক্ষমতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে; উদাহরণতঃ—পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা, রোগ নিয়ে রোযা রাখা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়া ইত্যাদি। সেটা আল্লাহ তাআলার এ বাণী বাস্তবায়নার্থে: "আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না" এবং তাঁর এ বাণীর বাস্তবায়নার্থে: "দ্বীনি ক্ষেত্রে তিনি তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপ করেননি"। এবং তাঁর এ বাণীরও বাস্তবায়নার্থে: "আল্লাহ্ তোমাদের ওপর কাঠিন্য আরোপ করতে চান না"। এবং সহিহ বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "তোমরা সহজকারীরূপে প্রেরিত হয়েছ; কাঠিন্য আরোপকারী হিসেবে নয়।"[মাজমুউল ফাতাওয়া (৮/৪৩৮-৪৩৯)]