ঢাকা, শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীসমাজ ও মাহরাম পুরুষদের সামনে একজন নারীর সতর

মোঃ আরিফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৬:৪২ এএম

নারীসমাজ ও মাহরাম পুরুষদের সামনে একজন নারীর সতর

এক:

মাহরাম পুরুষদের সামনে একজন নারীর সতর হচ্ছে তার গোটা দেহ; কেবল চেহারা, চুল, ঘাড়, হাতের বাহুদ্বয় ও পদযুগল যা সচরাচর প্রকাশিত হয়ে পড়ে সেগুলো ব্যতিত। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তারা যেন তাদের স্বামীগণ, পিতাগণ, স্বামীর পিতাগণ, ছেলেগণ, স্বামীর ছেলেগণ, ভাইগণ, ভাইয়ের ছেলেগণ, বোনের ছেলেগণ, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাস, যৌনকামনা রহিত অধীনস্থ পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ শিশুরা ছাড়া কারো নিকট নিজেদের সাজসজ্জা (সাজসজ্জার অঙ্গগুলো) প্রকাশ না করে।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩১]

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তাআলা নারীর জন্য তার স্বামীর সামনে ও তার মাহরামদের সামনে নিজের সাজসজ্জা প্রদর্শন জায়েয করেছেন। এখানে সাজসজ্জা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে— সাজসজ্জার স্থানগুলো। যেমন আংটি পরার স্থানের মধ্যে পড়বে হাতের কব্জি। চুড়ি পরার স্থানের মধ্যে পড়বে হাতের বাহু। কানফুল পরার স্থানের মধ্যে পড়বে কান। গলার হার পরার স্থানের মধ্যে পড়বে গলা, বুক। নূপুর পরার স্থানের মধ্যে পড়বে পায়ের গোছা।

আবু বকর আল-জাস্‌সাস তার তাফসিরে বলেন: “এ বাণীর বাহ্যিক মর্মের দাবী হচ্ছে সাজসজ্জা স্বামীর জন্য এবং পিতাসহ অন্য যাদেরকে স্বামীর সাথে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সামনে প্রকাশ করা বৈধ। জ্ঞাতব্য, সাজসজ্জা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে— সাজসজ্জার স্থান। আর সে স্থানগুলো হচ্ছে চেহারা, হাত ও হাতের বাহু...। তাই এই বাণীর দাবী হচ্ছে আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের জন্য উল্লেখিত স্থানগুলো দেখা বৈধ। এগুলো হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সাজের স্থান। কেননা আয়াতের প্রথমাংশে বাহ্যিক সাজসজ্জা গাইরে-মাহরাম ব্যক্তিদের জন্য দেখা জায়েয করা হয়েছে। আর স্বামী ও মাহরাম ব্যক্তিবর্গের জন্য আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা দেখাকে জায়েয করা হয়েছে। ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে: কানের দুল, গলার হার, চুড়ি ও নূপুর...।

যেহেতু আয়াতে স্বামী ও উল্লেখিত ব্যক্তিদের জন্য বিধানকে সমান করা হয়েছে তাই আয়াতের সামগ্রিকতার দাবী হচ্ছে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের জন্য এ সকল সাজসজ্জার স্থানের দিকে তাকানো বৈধ; যেমনিভাবে স্বামীর জন্য বৈধ।”[সমাপ্ত]

বাগাভী (রহঃ) বলেন: “নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে” অর্থাৎ গাইরে মাহরামের সামনে প্রকাশ না করে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সাজ। সাজ দুই প্রকার: আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। আভ্যন্তরীণ সাজ হল: নূপুর, পায়ের মেহেদি, হাতের কব্জিতে চুড়ি, কানের দুল ও গলার হার। তাই নারীর জন্য এগুলো প্রকাশ করা নাজায়েয এবং গাইরে মাহরামের জন্য এগুলো দেখা নাজায়েয। আর এখানে সাজ দ্বারা উদ্দেশ্য সাজের স্থান।”[সমাপ্ত]

কাশ্‌শাফুল ক্বিনা গ্রন্থে (৫/১১) বলেন: “পুরুষের জন্য তার মাহরাম নারীদের চেহারা, ঘাড়, হাত, পা, মাথা, পায়ের গোছা দেখা জায়েয। এই বর্ণনায় ক্বাযী বলেন: সচরাচর যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যেমন- মাথা, কনুই পর্যন্ত হাত দেখা বৈধ।”[সমাপ্ত]

এই মাহরামগণ নৈকট্যের দিক ও ফিতনা থেকে নিরাপদ হওয়ার দিকের বিবেচনা থেকে একই স্তরে নয়। তাই একজন নারী তার বাবার সামনে যা কিছু প্রকাশ করবেন তার স্বামীর ছেলের সামনে সেসব কিছু প্রকাশ করবেন না। কুরতুবী বলেন: “আল্লাহ্‌ তাআলা যখন স্বামীদের কথা উল্লেখ করলেন তখন তিনি তাদেরকে দিয়ে আলোচনা শুরু করেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে মাহরাম পুরুষদের কথা উল্লেখ করেন। সাজসজ্জা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণীর জন্য সমান বিধান দিয়েছেন। কিন্তু মানুষের মনে যা কিছুর উদ্রেক হয় সে বিবেচনা থেকে মাহরামদের মর্যাদার ভেদ রয়েছে। কোন সন্দেহ নাই যে, পিতার সামনে, ভাইয়ের সামনে নারীর কোন কিছু প্রকাশ করা স্বামীর ছেলের সামনে প্রকাশ করার চেয়ে অধিক নিরাপদ। অনুরূপভাবে মাহরামদের সামনে কোন অঙ্গটি প্রকাশ করা হচ্ছে সেটার বিবেচনা থেকেও স্তরভেদ রয়েছে। তাই পিতার সামনে এমন কোন অঙ্গ প্রকাশ করা বৈধ; যা স্বামীর ছেলের সামনে প্রকাশ করা বৈধ নয়।”[সমাপ্ত]

দুই:

ফিকাহবিদ আলেমদের নিকট স্বতঃসিদ্ধ এক নারীর কাছে অপর নারীর গোপন অঙ্গ হচ্ছে নাভী থেকে হাঁটুর মধ্যস্থিত স্থান; চাই সেই নারী মা হোক, বোন হোক, কিংবা অনাত্মীয় কোন নারী হোক। তাই কোন নারীর জন্য তার বোনের নাভী থেকে হাঁটুর মধ্যস্থিত স্থানটুকু দেখা বৈধ নয়; একান্ত জরুরী অবস্থা কিংবা চিকিৎসার মত তীব্র প্রয়োজন ছাড়া।

তার মানে এ নয় যে, একজন নারী নারীদের মাঝে তার নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত বাদ দিয়ে সমস্ত শরীর উন্মুক্ত করে বসে থাকবেন। এমন কাজ বেহায়া ও নির্লজ্জ কিংবা অশালীন ফাসেক মহিলারা ছাড়া আর কেউ করে না। ফিকাহবিদ আলেমদের উক্তি “গোপন অঙ্গ হচ্ছে: নাভী ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থান” কে ভুলভাবে বুঝা উচিত হবে না। তাদের এ কথার মধ্যে এমন কোন কিছু নাই যে, নারীর পোশাক এতটুকুন; যে পোশাক নারী সবসময় গায়ে পরবেন এবং যে পোশাক পরে আর বোন ও বান্ধবীদের সামনে আসবেন। কোন বিবেকবান মানুষ এমন অভিমতে সায় দিবেন না এবং স্বাভাবিক মানব প্রবৃত্তিও এর প্রতি আহ্বান করে না।

বরং নিজের বোনদের ও অন্য নারীদের সামনে তার পোশাক পরিপূর্ণ শরীর ঢাকে এমন হওয়া বাঞ্চনীয়; যা নারীর লজ্জাশীলতা ও গাম্ভীর্যের পরিচায়ক হবে। কাজের সময় ও কোন সেবা দেয়ার সময় যতটুকু প্রকাশ হয়ে পড়ে ততটুকুর বেশি প্রকাশ করবে না; যেমন- মাথা, গলা, দুই হাতের বাহু, দুই পায়ের পাতা; ঠিক ইতিপূর্বে মাহরামদের প্রসঙ্গে আমরা যেভাবে উল্লেখ করেছি।

HTML tutorial