ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ১৪, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
logo

প্রকাশিত; ১২ এপ্রিল, ২০২৫, ০৩:২০ পিএম

কুরআনের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও ইতিহাস

কুরআনের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও ইতিহাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত চূড়ান্ত গ্রন্থ, যা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের পথনির্দেশনা দেয়। এটি অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি পরিবর্তন ও বিকৃতির শিকার হয়নি, যা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন—
"আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই একে সংরক্ষণ করবো।" (সুরা আল-হিজর: ৯)
কুরআনের সংরক্ষণের এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, তার একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।

কুরআন সংরক্ষণের প্রথম ধাপ: নবী (সা.)-এর যুগ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে কুরআন সংরক্ষণের জন্য দুইটি প্রধান উপায় ছিল:

১. মুখস্থকরণ (হিফজ)

  • নবী (সা.)-এর সাহাবিরা কুরআনের আয়াত মুখস্থ করতেন এবং তা তাঁদের জীবনাচারে অনুসরণ করতেন।

  • সাহাবিদের মধ্যে আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.), আলী (রা.) সহ অনেকেই কুরআন সম্পূর্ণ মুখস্থ করেছিলেন।

২. লিখিত সংরক্ষণ

  • কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলে নবী (সা.) তা সঙ্গে সঙ্গে লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে নিতেন।

  • খেজুর পাতার টুকরো, চামড়া, পশুর হাড় ও পাথরের টুকরোতে কুরআনের আয়াত সংরক্ষণ করা হতো।

  • জাইদ ইবনে সাবিত (রা.), উবাই ইবনে কাব (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবি লিখনীর দায়িত্ব পালন করতেন।

আবু বকর (রা.)-এর যুগে সংকলন

নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইয়ামামার যুদ্ধে বহু হাফেজ কুরআন শহীদ হন, যা উমর (রা.)-কে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তিনি আবু বকর (রা.)-কে কুরআন একত্র করার পরামর্শ দেন।

  • আবু বকর (রা.) প্রথমবারের মতো কুরআন লিখিত আকারে একত্র করার নির্দেশ দেন।

  • জাইদ ইবনে সাবিত (রা.) এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

  • মুখস্থ করা ও লিখিত দলিল যাচাই করে কুরআন একত্রিত করা হয়।

  • সংকলিত কুরআন খলিফা আবু বকর (রা.)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল এবং পরবর্তীতে উমর (রা.) ও পরে উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.)-এর কাছে রাখা হয়।

উসমান (রা.)-এর যুগে কুরআনের প্রতিলিপি তৈরি

খলিফা উসমান (রা.)-এর সময় ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন উচ্চারণ ও পাঠভঙ্গির কারণে কিছু মতভেদ দেখা দেয়। তখন তিনি কুরআনের একটি নির্দিষ্ট পাঠভঙ্গি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।

  • হাফসা (রা.)-এর সংরক্ষিত মূল পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিলিপি তৈরি করা হয়।

  • একই উচ্চারণভঙ্গির উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি কপি তৈরি করে মুসলিম বিশ্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

  • যেসব ব্যক্তিগত সংগ্রহে পার্থক্য ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে এককভাবে নির্ভুল কুরআন সংরক্ষিত থাকে।

পরবর্তী যুগে সংরক্ষণ ও প্রসার

উসমান (রা.)-এর সংকলিত কুরআন আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। পরবর্তী সময়ে মুসলিম উম্মাহ কুরআন সংরক্ষণের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

১. আরবি বিন্দু ও উচ্চারণ চিহ্ন সংযোজন

  • ইসলামের প্রসার ঘটার ফলে অনারবদের জন্য উচ্চারণ সহজ করতে হজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কুরআনে বিন্দু ও উচ্চারণ চিহ্ন সংযোজন করেন।

২. মুদ্রণ ও ডিজিটাল সংরক্ষণ

  • মুদ্রণযুগে মদিনার "কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স" থেকে লক্ষাধিক কুরআনের কপি ছাপানো হয়।

  • বর্তমানে ডিজিটাল ফরম্যাটেও কুরআন সংরক্ষিত ও সহজলভ্য রয়েছে।

উপসংহার

কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস ইসলামের অন্যতম বিস্ময়কর দিক। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর এক অক্ষরও পরিবর্তন হয়নি। মুখস্থ, লিখিত সংকলন, উসমানি প্রতিলিপি এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষিত রয়েছে। কুরআনের এই সংরক্ষণের অলৌকিকত্ব ইসলামের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ।