বাইতুল মাকদাসের নির্মাণ
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, বাইতুল মাকদাস (মসজিদ আল-আকসা) প্রথম নির্মাণ করেন নবী আদম (আঃ)। পরে এই মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন করেন নবী ইবরাহিম (আঃ), এবং নবী সুলাইমান (আঃ) এটিকে পরিপূর্ণতা দেন। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম ইবাদতস্থল, যা কাবা শরীফের ৪০ বছর পর নির্মিত হয় বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
বাইতুল মাকদাসের বিজয়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস
বাইতুল মাকদাস, যেটি আল-কুদস নামেও পরিচিত, ইসলামের প্রথম কিবলা এবং তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। এটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। ইসলামের প্রথম যুগে, বাইতুল মাকদাস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। বাইজেন্টাইনরা তাদের প্রভাব ধরে রাখতে ইসলামের দ্রুত বিস্তারের মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনামলে ইসলামী সেনারা সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলে বিজয় লাভ করতে থাকে। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়ারমুকের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার পর মুসলিম বাহিনী সরাসরি বাইতুল মাকদাসের দিকে অগ্রসর হয়।
মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সাহাবি আবু উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ (রা.)। তিনি কৌশলগতভাবে বাইতুল মাকদাস ঘিরে ফেলে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বাইজেন্টাইন শাসকরা দীর্ঘ সময় প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও মুসলিম বাহিনীর অদম্য সাহস এবং ধৈর্যশীলতার কাছে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাইজেন্টাইনদের পক্ষ থেকে প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস নামক ধর্মীয় নেতা শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণে সম্মত হন। তিনি বলেন, শহরটি শুধুমাত্র মুসলিম খলিফার হাতেই তুলে দেওয়া হবে। উমর (রা.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করে মদিনা থেকে বাইতুল মাকদাসে আসেন।
উমর (রা.) শহরে অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে প্রবেশ করেন, যা তার সাদাসিধে জীবনের প্রতিফলন। শহরের অধিবাসীরা তার ন্যায়পরায়ণতা এবং বিনম্রতায় মুগ্ধ হয়। তিনি বাইতুল মাকদাসের অধিবাসীদের জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেন। প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াসের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা "উমর চুক্তি" নামে পরিচিত।
উমর (রা.) শহর পরিদর্শন করেন এবং প্রার্থনার জন্য এক স্থান নির্বাচন করেন, যা পরবর্তীতে "মসজিদ আল-আকসা" হিসেবে পরিচিত হয়। এই বিজয়ের ফলে বাইতুল মাকদাস ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এটি একটি শান্তিপূর্ণ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার আওতায় আসে।
প্রথম ক্রুসেডের সময় (১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে) বাইতুল মাকদাস খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায়। শহরটি ক্রুসেডারদের সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়, এবং তারা মুসলমান ও ইহুদিদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালায়। এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
সলাহউদ্দিন আইয়ুবি, একজন প্রখ্যাত কুর্দি নেতা এবং ইসলামী সেনাপতি, মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার লক্ষ্য ছিল বাইতুল মাকদাস পুনরুদ্ধার করা। তিনি তার সেনাবাহিনী সংগঠিত করে এবং বাইতুল মাকদাসের দিকে অগ্রসর হন।
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে "হিট্টিনের যুদ্ধ" সলাহউদ্দিনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ক্রুসেডারদের সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। মুসলিম বাহিনীর সংগঠিত কৌশল এবং নেতৃত্বের কারণে ক্রুসেডাররা সম্পূর্ণরূপে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
হিট্টিনের বিজয়ের পর সলাহউদ্দিন বাইতুল মাকদাসে অভিযান শুরু করেন। ক্রুসেডাররা শহরটি রক্ষা করার জন্য শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সলাহউদ্দিনের বাহিনী তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়। শেষপর্যন্ত ক্রুসেডার শাসকরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
সলাহউদ্দিন একজন উদার নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ক্রুসেডারদের হত্যা না করে তাদের নিরাপদে শহর ত্যাগ করার সুযোগ দেন। শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।
সলাহউদ্দিন মসজিদ আল-আকসা পুনরায় মুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত করেন এবং বাইতুল মাকদাসে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার এই বিজয় মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্য এবং শক্তি পুনর্জাগরিত করে।
সলাহউদ্দিনের মৃত্যুর পর বাইতুল মাকদাসে ক্রুসেডারদের আক্রমণ পুনরায় শুরু হয়। ১২২৯ সালে ক্রুসেডাররা আবার শহরটি দখল করে। মামলুক সাম্রাজ্য, যারা তখন মুসলিম বিশ্বের একটি শক্তিশালী অংশ, বাইতুল মাকদাস পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হয়।
১২৪৪ সালে মামলুক বাহিনী বিশাল সেনা অভিযানের মাধ্যমে বাইতুল মাকদাস পুনরুদ্ধার করে। ক্রুসেডাররা তৎকালীন সময়ে বড় কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। মামলুকদের বিজয়ের মাধ্যমে বাইতুল মাকদাস চূড়ান্তভাবে মুসলিমদের শাসনের অধীনে আসে।
মামলুক শাসকদের অধীনে বাইতুল মাকদাসে সামাজিক ও ধর্মীয় উন্নয়ন ঘটে। তারা মসজিদ আল-আকসাসহ শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো পুনরুদ্ধার করেন এবং এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পুনর্বাসিত হয়।
বাইতুল মাকদাসের এই তিনটি বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সাহসিকতা, নেতৃত্ব এবং ঈমানের প্রতিফলন। প্রতিটি বিজয়ে মুসলিম নেতারা কেবল সামরিক দক্ষতা নয়, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা এবং কৌশলগত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। উমর (রা.)-এর ন্যায়পরায়ণতা, সলাহউদ্দিনের উদারতা এবং মামলুক শাসকদের দৃঢ়তা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায় তৈরি করেছে।