ঢাকা, মঙ্গলবার, আগস্ট ১২, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সেই হৃদয়ের পরিবার আমন্ত্রণ পাননি উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে

মুক্তধ্বনি নিউজ ডেস্ক

গোপালপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৬ জুলাই, ২০২৫, ০৭:৪০ পিএম

সেই হৃদয়ের পরিবার আমন্ত্রণ পাননি উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে
HTML tutorial

জুলাই বিপ্লবে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটি  ভিডিও, প্রকাশ্যে দিবালোকে ১০/১২জন পুলিশ একজনকে ঘেরাও করে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলির পর দেহ টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানা যায় কোটি কোটি মানুষের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়া মানুষটি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের কলেজ ছাত্র হৃদয়। হৃদয়ের পরিবারের দাবি, গত ৫ আগষ্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে  হত্যার পর লাশ টেনেচেড়ছে নেয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। একমাত্র পুত্র হৃদয়ের এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের শোক এখনো ভুলতে পারেননি পরিবার। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার ছিল জুলাই শহীদ দিবস-২০২৫। সেই দিবস স্মরণে  গোপালপুর উপজেলা প্রশাসন উপজেলা পরিষদ হল রুমে আয়োজন করে দোয়া, সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা। সেই অনুষ্ঠানে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও  শহীদ হৃদয়ের পরিবারকে ডাকা হয় নাই। সরকার ঘোষিত এমন একটা দিবসে উপজেলা প্রশাসন শহীদ পরিবারকে আমন্ত্রণ না জানানোয় সবাই বিস্মিত হয়েছেন। হৃদয়ের পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের এমন আচরণের নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আলমনগর উত্তরপাড়ার দিন মজুর লাল মিয়ার এক মাত্র পুত্র হৃদয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনা করতো। সংসারে অনটনের কারণে হৃদয় গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীতে বোন জামাই ইব্রাহীমের সাথে থেকে অটোরিকসা চালাতো। এ আয়ে পঙ্গু বাবা-মার খাবারদাবার ও নিজের পড়াশোনার খরচ চলতো। ইব্রাহীম মিয়া গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া মামলার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান,  গত ৫ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার পলায়নের পর কোনাবাড়ীতে ছাত্র জনতার বিজয় মিছিলে অংশ নিলে পুলিশ তাকে আটক করে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকান্ডে ভাইরাল হওয়া ভিডিও থেকে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা হৃদয়কে  গলির ভিতর থেকে ধরে এনে কোনাবাড়ীর শরীফ মেডিকেলের সামনে মারধোর করছে। বাঁচার জন্য সে পুলিশের হাতে পায়ে ধরছে। এক পর্যায়ে একজন পুলিশ সদস্য বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করছে। সেখানে ধোঁয়া উড়ছে।  পুলিশ চলে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ দাপড়িয়ে হৃদয় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর পুলিশের আরেকটি দল এসে তার লাশ টেনে হিঁচড়ে কোনাবাড়ী থানার ভিতরে নিয়ে যায়।

মামলার বাদী আরো জানান, গোলাগুলির সময় তিনি কাছের ভবনে আশ্রয় নেন। হৃদয়কে ধরে নিতে এবং দূর থেকে গুলি করতে দেখেন।  পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে থানায় গিয়ে দেখেন পুলিশ শূন্য। এরপর লাশের সন্ধানে বহুবার থানায় ধর্ণা দিয়েও লাভ হয়নি। গত ২৬ আগষ্ট কোনাবাড়ী থানার তদানিন্তন ওসি মোঃ শাহ আলম ডেকে নিয়ে লীগ সরকারের ৫৭ নেতাকর্মী এবং অজ্ঞাতনামা কয়েক পুলিশ সদস্যকে আসামী করা এজাহারে স্বাক্ষর নেন। গাজীপুর পুলিশ সুপারের নিকট দায়ের করা অভিযোগে পরবর্তীতে তিনি জানান, ঘটনার দিন দায়িত্বরত পুলিশরাই  হৃদয়কে হত্যা ও গুম করে। মামলার প্রথম তদন্তকারি অফিসার উৎপল কুমার সাহা ভাইরাল ভিডিও পর্যালোচনা করে এক প্রতিবেদনে আদালতকে জানান, হৃদয় হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন কনষ্টেবল আকরাম হোসেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়।  

এদিকে আদালতের এক নির্দেশে গত ২৮ জানুয়ারী হৃদয় হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান গাজীপুর ডিবির এসআই মোঃ ইব্রাহীম হোসেন। তিনি জানান, হত্যাকান্ডের প্রমাণ সেই ভাইরাল ভিডিওসহ অন্যান্য ডকুমেন্টস, সাক্ষী ও আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুব দ্রুতই মামলার চূড়ান্ত অভিযোগনামা দাখিল করা হবে। হৃদয়ের মা রেহানা বেগম জানান, পুত্রের লাশ এক নজর দেখার জন্য এখনো হৃদয় কাঁদে। বাড়িতে পঙ্গু স্বামী। সম্পত্তি বলতে তিন শতাংশের ভিটে। মহাজনী ঋণের আড়াই লক্ষ টাকায় ছেলেকে অটো কিনে দেন। এর আয়ে পেট চলতো। এখন অটোর চাকা বন্ধ হওয়ায় সংসারের চাকা বন্ধ হওয়ার দশা। হৃদয়ের ভগ্নী জেসমিন জানান, জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহিদদের অনেক পরিবার সরকারি অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু লাশ গুম হওয়ায় শহিদ তালিকায় হৃদয়ের স্থান হয়নি। সম্প্রতি শহিদ তালিকায় হৃদয়কে অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে গোপালপুর উপজেলা পরিষদ ঘেরাও এবং মানব বন্ধন করেন। আজকের অনুষ্ঠানে পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানানোয় প্রমানিত হয় গোপালপুর উপজেলা প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা লুকিয়ে রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাষ্টিস প্রজেক্ট এবং টেক গ্লোবাল ইন্সষ্টিটিউট হৃদয় হত্যার ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্য চিত্র বানিয়েছে। সেই প্রামাণ্য চিত্রের নির্মম দৃশ্য নেট জগতে ভাইরাল। গোপালপুর উপজেলা জামায়াতের আমীর হাবিবুর রহমান জানান, ৫ আগষ্ট হৃদয় পুলিশের শহীদ হন। তার দলের নেতারা পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে সাত্বনা, তালিকাভূক্তকরণ এবং বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি জুলাই শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ না জানানোর নিন্দা জানান। গোপালপুর পৌর বিএনপির সম্পাদক চাঁন মিয়া জানান, হৃদয় ৫ আগষ্ট শহীদ হন এটা সবাই জানেন। উপজেলা প্রশাসন তার পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে বৈষম্য করেছেন। এ ব্যাপারে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তুহিন হোসেন জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কেন তারা হৃদয়ের পরিবারের জানায়নি তা তিনি জানেননা। তাছাড়া জুলাই ফাউন্ডেশনের শহীদ তালিকায় হৃদয়ের নাম যুক্ত হয়নি। তার নাম যাতে অন্তর্ভূক্ত হয় সে জন্য প্রশাসনিক চেষ্টা চলছে। ওই অসহায় পরিবারকে বেশ কয়েকবার নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে

মু্ক্তধ্বনি অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

Google News Icon গুগল নিউজে দেখুন

বাংলাদেশ রিলেটেড নিউজ

HTML tutorial