ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ৭, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাবলিগ জামাতের ইজতেমায় বিভক্তি কেন? সাদ ও জুবায়ের পন্থীদের মধ্যে মতভেদ কিসের জন্য?

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৬ নভেম্বর, ২০২৪, ০২:৫৯ এএম

তাবলিগ জামাতের ইজতেমায় বিভক্তি কেন? সাদ ও জুবায়ের পন্থীদের মধ্যে মতভেদ কিসের জন্য?
HTML tutorial

তাবলিগ জামাতের ইজতেমা নিয়ে বাংলাদেশে কিছু বিভক্তি এবং মতভেদ তৈরি হয়েছে, যা মূলত দুটি পক্ষের মধ্যে বিভক্তি হিসেবে দেখা যায়: সাদ পন্থী এবং জুবায়ের পন্থী।

(ক) ইজতেমার পটভূমি এবং দুই পক্ষের গঠন?

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের ইজতেমা (বিশ্ব ইজতেমা) অনেক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাবলিগ জামাতের ভেতরে কিছু মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, যা দুই পক্ষের মধ্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে:

সাদ পন্থী: এই দলের অনুসারীরা ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্দেশনার প্রতি অনুগত। মাওলানা সাদ তাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তবে তার কিছু মতামত নিয়ে বিভিন্ন দেশে তাবলিগ জামাতের ভেতরে মতভেদ শুরু হয়। তার বেশ কিছু বক্তব্যকে বিতর্কিত এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করা হয়।

জুবায়ের পন্থী: এই দলটি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব মাওলানা জুবায়ের অনুসরণ করে। তারা মাওলানা সাদকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিকে যথাযথ মনে করেন না। এই দলটি মূলত তাবলিগ জামাতের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত নির্দেশিকা এবং শিক্ষা পদ্ধতি মেনে চলে।

(খ) সাদ কান্ধলভীর বিতর্কিত বক্তব্যসমূহ?

মাওলানা সাদ কান্ধলভীর কিছু বক্তব্য নিয়ে তাবলিগ জামাতের ভেতরে মতভেদ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে তার কিছু বিতর্কিত বক্তব্য তুলে ধরা হলো, যা অনেক আলেম ও তাবলিগের সদস্যের কাছে বিভ্রান্তিকর এবং ইসলামের মূলধারার দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাজনক মনে করা হয়।

১. তাবলিগ জামাতকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হিসেবে উল্লেখ করা।

মাওলানা সাদ একটি বক্তব্যে তাবলিগের দাওয়াতি কার্যক্রমকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "তাবলিগের কাজের সাথে যুক্ত না হলে মানুষ পরিপূর্ণভাবে ইসলামে থাকতে পারবে না।" এই বক্তব্যটি বিতর্কিত হয়েছে, কারণ ইসলামে অনেক ইবাদতের বিধান রয়েছে এবং একটিকে অন্যটির ওপরে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দাবি করা কিছু আলেমের মতে ভুল।

২. কোরআন ও হাদিসের বাইরে দাওয়াতের ধরন নির্ধারণ।

মাওলানা সাদ দাবি করেন যে, তাবলিগের দাওয়াতি কার্যক্রমে যারা অংশগ্রহণ করেন, তাদের জন্য কোরআন এবং হাদিসের কিছু নির্দেশনা ও বিধি অগ্রাধিকার দিতে হবে না, বরং তাবলিগের নিজস্ব দাওয়াত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এটি অনেকের মতে দাওয়াতের মূল পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং ইসলামের বিধানের বাইরে চলে যায়।

৩. কোরআন পাঠের তুলনায় দাওয়াতের গুরুত্ব বাড়ানো।

মাওলানা সাদ একটি বক্তব্যে বলেন যে, দাওয়াতের কাজে অংশগ্রহণ কোরআন পাঠের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি অনেক আলেমের মতে অগ্রহণযোগ্য, কারণ ইসলামে কোরআন পাঠের গুরুত্ব অত্যধিক এবং তা সকল ইবাদতের মূল।

৪. দোয়া সম্পর্কিত বিতর্কিত বক্তব্য।

মাওলানা সাদ একবার বলেন যে, "আল্লাহ দোয়া কবুল করেন কেবলমাত্র তখন, যখন মানুষ দাওয়াতের কাজ করে।" এই বক্তব্যটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ ইসলামে দোয়া কবুলের জন্য নির্দিষ্ট কাজের শর্ত নেই এবং আল্লাহ সব অবস্থায় বান্দার দোয়া কবুল করতে পারেন।

৫. রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আদর্শ পরিবর্তন সংক্রান্ত কথা।

মাওলানা সাদ কিছু বক্তব্যে তাবলিগ জামাতের দাওয়াত পদ্ধতিকে নবীজির (সা.) মূল পদ্ধতির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, "আমাদের দাওয়াতের পদ্ধতি নবীজির যুগের চেয়েও বেশি কার্যকর।" এই মন্তব্যটি অনেকের কাছে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভ্রান্তিকর মনে হয়, কারণ রাসূল (সা.) এর আদর্শই ইসলামের সর্বোচ্চ আদর্শ। HTML tutorial

৬. অন্য ইসলামী সংগঠনের সমালোচনা।

মাওলানা সাদ কিছু বক্তব্যে অন্য ইসলামী সংগঠনের কাজকে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন যে, "তাবলিগ জামাতই একমাত্র সঠিক পথ এবং বাকি সংগঠনগুলোর কাজ প্রকৃত ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।" এই মন্তব্যটি তাবলিগের ঐক্যের জন্যও নেতিবাচক বলে মনে করেন অনেকেই।

৭. নারীদের দাওয়াতের কাজে যোগদান নিয়ে নির্দেশনা।

মাওলানা সাদ নারীদেরও তাবলিগের কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছেন, যা কিছু ইসলামী পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে বিতর্কিত। কারণ ইসলামে নারীদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তারা সাধারণত ঘরে থেকেই ইবাদতের কাজ করেন।

৮. নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় দাওয়াতকে অগ্রাধিকার।

তিনি বলেন, "দাওয়াতের কাজ করলে নামাজের নিয়ম মেনে চলার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।" এ ধরনের বক্তব্য তাবলিগের প্রচলিত পদ্ধতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং ইসলামের মৌলিক বিধানের বিরোধী বলে অনেকেই মনে করেন। HTML tutorial

(গ) কেনো দুটি পক্ষ?

মাওলানা সাদের মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক তৈরির কারণে তাবলিগ জামাতের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ সাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে মান্য করে, এবং অন্য পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে জুবায়ের সাহেবের নেতৃত্বকে মেনে চলে। এই কারণে, ইজতেমা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে এবং তা আলাদা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এই মতপার্থক্য দূর করা নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা হয়েছে, তবে এখনো এর সমাধান পুরোপুরি হয়নি।

মু্ক্তধ্বনি অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

Google News Icon গুগল নিউজে দেখুন
HTML tutorial