কুরআন হলো ইসলামের প্রধান গ্রন্থ, যা মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য সর্বোত্তম দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তবে কুরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝতে তাফসির (ব্যাখ্যা) প্রয়োজন হয়। কুরআনের তাফসির কেবল ভাষাগত ব্যাখ্যা নয়, বরং এটি কুরআনের গভীর অর্থ ও প্রসঙ্গ বুঝতে সাহায্য করে। এই নিবন্ধে কুরআন ও হাদিসের আলোকে কুরআনের তাফসির কীভাবে করা হয় তা বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
‘তাফসির’ শব্দটি আরবি فَسَّرَ (ফাস্সারা) ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো "ব্যাখ্যা করা", "উন্মোচন করা"। ইলমুত-তাফসির (তাফসিরবিদ্যা) হলো কুরআনের অর্থ, ভাষা, উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করার বিজ্ঞান।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"এটি এক মহা বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।" (সূরা ছাদ: ২৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআনের অর্থ বোঝার জন্য গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা জরুরি, আর এটি সম্ভব তাফসিরের মাধ্যমে।
কুরআনের তাফসির করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মূলনীতি রয়েছে। এগুলো মূলত চারটি প্রধান উৎসের ভিত্তিতে করা হয়:
কুরআনের অনেক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা করে। যখন কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা স্পষ্ট না হয়, তখন অন্য আয়াত দ্বারা তার অর্থ বোঝা যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
সূরা ফাতিহার "সিরাতুল মুস্তাকিম" (সঠিক পথ) বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সূরা আন-নিসার ৬৯ নম্বর আয়াতে, যেখানে বলা হয়েছে যে এটি নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের পথ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী। আল্লাহ তাআলা তাঁকে কুরআন বোঝার ও বোঝানোর দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন:
"আমি তোমার প্রতি স্মরণিকা (কুরআন) নাজিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে।" (সূরা নাহল: ৪৪)
উদাহরণ:
সূরা বাকারা ২:২৮৫-তে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে পাই, বিশেষ করে জিবরাইল (আ.)-এর হাদিসে।
সাহাবিরা (রা.) সরাসরি নবী (সা.)-এর কাছ থেকে কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা কুরআনের সঠিক অর্থ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখতেন। তাই তাঁদের ব্যাখ্যা তাফসিরের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
উদাহরণ:
ইবনে আব্বাস (রা.)-কে তাফসিরবিদদের নেতা বলা হয়। তিনি নবী (সা.)-এর কাছ থেকে সরাসরি তাফসির শিখেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা বহু প্রসিদ্ধ তাফসির গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
তাবেয়িগণ সাহাবিদের থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা শিখেছেন। তাদের ব্যাখ্যাগুলোও নির্ভরযোগ্য এবং তাফসিরে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
ইমাম মুজাহিদ, কাতাদা, হাসান বসরি প্রমুখ তাবেয়িরা কুরআনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, তাই তাফসির করতে হলে আরবি ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, অলঙ্কার ও সাহিত্য বিশ্লেষণ করা হয়।
তাফসির সাধারণত দুইভাবে করা হয়:
এটি কুরআন, হাদিস, সাহাবি ও তাবেয়িদের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে করা হয়।
প্রসিদ্ধ তাফসির:
তাফসির ইবনে কাসির
তাফসির আত-তাবারি
তাফসির আস-সা’দি
এটি ভাষা, ব্যাকরণ ও ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা হয়, তবে এটি নির্ভরযোগ্য হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
প্রসিদ্ধ তাফসির:
তাফসির আল-জালালাইন
তাফসির আল-কুরতুবি
কিছু মানুষ কুরআনের আয়াতকে ভুল ব্যাখ্যা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই সঠিক তাফসিরের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত:
১. তাফসির কুরআন, হাদিস ও সাহাবিদের বক্তব্য অনুযায়ী হতে হবে। ২. ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ইসলামি স্কলারদের মতামত অনুসরণ করতে হবে। ৩. শুধু ভাষাগত অনুবাদ নয়, বরং আয়াতের শানে নুযুল (অবতরণের প্রেক্ষাপট) জানা জরুরি। ৪. বিদআত ও মনগড়া ব্যাখ্যা পরিহার করতে হবে।
কুরআনের তাফসির একটি গভীর জ্ঞানসম্পন্ন শাস্ত্র, যা সঠিক পদ্ধতিতে করতে হয়। কুরআন, হাদিস, সাহাবি ও তাবেয়িদের বক্তব্যের আলোকে তাফসির করলে তা নির্ভরযোগ্য হয়। আজকের যুগে সঠিক ইসলামি স্কলারদের রচিত তাফসির অধ্যয়ন করে কুরআনের গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
আল্লাহ আমাদের কুরআন বোঝার ও তা অনুসারে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
মু্ক্তধ্বনি অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন